স্বয়ংক্রিয় এসক্রো সেবা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারায় ই-কমার্সের লেনদেনে ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। কার্যত, অনলাইন কেনাকাটায় ই-পেমেন্ট কাজ করছে না। ক্যাশ অন ডেলিভারি, অর্থাৎ পণ্য সরবরাহের সময় নগদে মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থায় এখন বেশিরভাগ লেনদেন করছেন ই-কমার্সের ক্রেতা-বিক্রেতারা। সংশ্নিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে ৯৫ শতাংশের বেশি লেনদেন হচ্ছে ক্যাশ অন ডেলিভারিতে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, পণ্য সরবরাহের পর ক্রেতার পরিশোধ করা টাকা বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে জমার নিয়ম (এসক্রো সার্ভিস) চালুর পরে ই-পেমেন্ট ব্যাপকভাবে ধাক্কা খেয়েছে। শুরুর দিকে কিছু অর্ডার এ পদ্ধতিতে হচ্ছিল। পরে দেখা যায়, বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান পণ্য সরবরাহের পরেও সময়মতো টাকা পাচ্ছে না। আবার পণ্য না পেলে ক্রেতারা সময়মতো টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না। ক্রেতা-বিক্রেতা সবার টাকা পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিতে আটকে থাকছে। এ কারণে ক্রেতা-বিক্রেতারা অনলাইন পেমেন্ট থেকে সরে এসেছেন।
গত বছর বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর এসক্রো সার্ভিস চালু হয়। এর আগে অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের থেকে আগাম টাকা নিত। কিন্তু সময়মতো পণ্য সরবরাহ করেনি। তদন্তে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের অর্ডারের সমান পণ্য নেই। এমনকি পণ্য কেনার প্রয়োজনীয় টাকাও তাদের অ্যাকাউন্টে নেই। ক্রেতা ও পণ্য সরবরাহকারীদের শত শত কোটি টাকা তছরুপ করেছে এসব প্রতিষ্ঠান।
এ পরিস্থিতিতে গত বছরের ৩০ জুন সরকার ই-কমার্সের আগাম পরিশোধকে নিরাপদ করতে এসক্রো সার্ভিস চালু করে। এ সেবা হলো, ক্রেতা কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিলে সেই টাকা মধ্যবর্তী কোনো পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিতে থাকবে। ক্রেতা পণ্য বুঝে পেলে পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করবে। পদ্ধতিটি ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্য ভালো। কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ম্যানুয়ালি এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এর কোনো প্রযুক্তিগত পদ্ধতি এখনও দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। ফলে একটি লেনদেন শেষ হতে অনেক সময় লাগছে। আবার কোনো লেনদেন না হলে ক্রেতারা রিফান্ড পাচ্ছেন না। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই এ পদ্ধতিতে আগ্রহ হারিয়ে নগদে লেনদেন করছেন।
সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, শিগগিরই স্বয়ংক্রিয় এসক্রো সার্ভিস চালু হচ্ছে না। কারণ স্বয়ংক্রিয় সেবার জন্য পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিক প্রযুক্তিগত কাঠামো দরকার। দেশে অনেক কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ই-কমার্সের পণ্য সরবরাহ করলেও স্বয়ংক্রিয় এসক্রো সেবায় যুক্ত হওয়ার উপযুক্ত কাঠামো কারোই নেই। এ বিষয়ে ডাক বিভাগ কাজ করছে। তবে এ বিভাগের সংশ্নিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়েই রয়েছে।
এ বিষয়ে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম ফাহিম মাশরুর সমকালকে বলেন, এসক্রো ব্যবস্থা ম্যানুয়ালি হওয়ায় এর কার্যক্রমে ধীরগতি রয়েছে। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতারা অনলাইন পেমেন্টের পরিবর্তে ক্যাশ অন ডেলিভারিতে ঝুঁকছেন। তিনি বলেন, ছয় মাস আগে মোট লেনদেনের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ লেনদেন অনলাইনে হতো। বর্তমানে তা ৫ শতাংশে নেমেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান এএইচএম সফিকুজ্জামান সমকালকে বলেন, স্বয়ংক্রিয় এসক্রো ব্যবস্থা চালুর জন্য আইসিটি বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্নিষ্ট পক্ষগুলো কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মো. মেজবাউদ্দিন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্সের অনলাইন পরিশোধ তুলনামূলকভাবে কমেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত বছরের ৩০ জুনের পরে বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিতে ই-কমার্সের ক্রেতাদের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আটকা পড়েছে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক অনুষ্ঠানে পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানি ফস্টারের সিনিয়র ম্যানেজার আল বেরুনি জানান, ৩০ জুনের পরে তাদের কোম্পানিতে গ্রাহকদের ১৭৬ কোটি টাকা আটকা পড়েছে। ই-ক্যাবের সহসভাপতি মো. সাহাব উদ্দিন সমকালকে বলেন, এসক্রো ব্যবস্থা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে। এখন ম্যানুয়ালি পরিচালিত হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, শিগগিরই আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত স্বয়ংক্রিয় এসক্রো চালু হবে।
কমেছে কেনাকাটা: করোনায় সব ধরনের কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়লেও ই-কমার্স খাত ছিল তার বিপরীত। ঘরবন্দি মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার জন্য অনলাইননির্ভর কেনাকাটায় ঝুঁকে পড়েন। এতে দেশের ই-কমার্স খাতের কেনাবেচা রাতারাতি অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু কিছু মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ডে সম্প্রতি উদীয়মান এ খাতটিতে চাহিদা কমে গেছে। পাশাপাশি সাধারণ বাজার, শপিংমল, দোকানপাট খুলে যাওয়ার ফলেও ই-কমার্সে কেনাবেচা কমায় ভূমিকা রেখেছে। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন দেখা দেওয়ার পর পুনরায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। মানুষ কাজে ফিরলেও কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাবও পড়েছে ই-কমার্সে।
ফাহিম মাশরুর বলেন, ই-কমার্স খাত আপাতত প্রবৃদ্ধি ছাড়াই চলছে। ই-ক্যাবের বক্তব্যও তার তথ্যকেই সমর্থন করছে। সংগঠনটির একজন কর্মকর্তা বলেন, সর্বশেষ দুই মাসের তথ্য এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি তেমন হয়নি।
কৃতজ্ঞতাঃ সমকাল
মন্তব্য করুন