ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়ে এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে শুরু হয় করোনার টিকাদান কর্মসূচি। ফাইজারের টিকা দেশে
এর মধ্যে ভারত গত মার্চে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ে সেই কার্যক্রম। আলোচনা-সমালোচনার মুখে সংকট নিরসনে নানামুখী তৎপরতা শুরু করে সরকার।
দেড় কোটি ডোজ টিকা কিনতে চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। নতুন করে আরও ছয় কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। পাশে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও।
সবার জন্য টিকা নিশ্চিতের বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে টিকা পাঠায়। এ উদ্যোগের আওতায় ডিসেম্বরের মধ্যে বিনামূল্যে প্রায় ছয় কোটি ডোজ টিকা মিলবে।
তবে কোন টিকা কী পরিমাণ, কোন মাসে পাওয়া যাবে তা জানায়নি কোভ্যাক্স।
দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এ বিপুল চাহিদার বিপরীতে জোগানের উৎস হিসেবে বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স ও চীনের সিনোফার্মের টিকা হয়ে উঠেছে
ভরসাস্থল।
৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হলে দুই ডোজ মিলিয়ে প্রয়োজন ২৭ কোটি ৪ লাখ ১ হাজার ৬০০ ডোজ। তবে এক ডোজ টিকার ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা হবে কিছু কম।
এখন পর্যন্ত দেশে যত মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে তার বড় অংশের উৎস কোভ্যাক্স ও সিনোফার্ম।
আগামীতে গণটিকাদান কর্মসূচি চলমান রাখার যে মাস্টারপ্ল্যান তা কোভ্যাক্স ও সিনোফার্মের টিকাকে ঘিরেই করা হয়েছে।
আগে দেড় কোটি ডোজ কেনার চুক্তির অনুযায়ী টিকা পাঠাচ্ছে সিনোফার্ম। নতুন ছয় কোটি কেনার যে চুক্তি তা আগামী মাস থেকে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অন্যদিকে সিনোফার্মের সঙ্গে বাংলাদেশি ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি ইনসেপ্টার করোনার টিকা সহ-উৎপাদনের বিষয়ে চুক্তি আগামী সপ্তাহের যে কোনো দিন হবে বলে জানা গেছে।
তবে রাশিয়ার সঙ্গে টিকা কেনা ও সহ-উৎপাদকের চুক্তি ঝুলে গেছে বলে কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে।
কোভ্যাক্সের আওতায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ১ কোটি ৬ লাখ ৭০ হাজার টিকা পেয়েছে। সর্বশেষ চালান হিসেবে গত বুধবার কোভ্যাক্সের মাধ্যমে চীন থেকে ১৭ লাখ ৭৭ হাজার সিনোফার্মের টিকা আসে।
আরও ১০ লাখ টিকা আসা পাইপলাইনে আছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, কোভ্যাক্স বাংলাদেশকে ডিসেম্বরের মধ্যে ছয় কোটি ডোজ টিকা দেবে বলে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে।
এ গুলো পাওয়া যাবে বিনামূল্যে। এর পর কোভ্যাক্সের আওতায় চাইলে বাংলাদেশ টিকা কিনতে পারবে।
দরিদ্র দেশগুলোতে টিকাদান নিশ্চিতের বৈশ্বিক জোট গ্যাভির ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কোভ্যাক্স আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ১৯০ কোটি টিকা বিতরণ করতে চায়।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা না পেয়ে কোভ্যাক্স বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহে জোর দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মাসে গ্যাভি চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক টিকা কেনার জন্য আগাম ক্রয় চুক্তি করে।
গ্যাভির ওয়েবসাইটে তুলে ধরা এক বক্তব্যে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেথ বার্কলে বলেন, ‘চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তির ফলে কোভ্যাক্সের অংশীদারেরা খুব শিগগিরই টিকা হাতে পাবেন। কোভ্যাক্স এখন পর্যন্ত অন্তত ১১টি টিকা উৎপাদনকারী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে।
এদিকে দেশে এখন পর্যন্ত ২ কোটি ৮৯ হাজার ১০৭ ডোজ করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া গতকাল পর্যন্ত ৩ কোটি ৪ লাখের মতো মানুষ টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন।
এদিকে প্রতিদিনই টিকার নিবন্ধনকারীর সংখ্যা ১২ থেকে ১৫ লাখ করে বাড়ছে। বর্তমানে নিববন্ধনকারীদেরই সবমিলিয়ে টিকা দরকার ৩ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার ৯৯৫ ডোজ। বিভিন্ন হিসাব করে দেখা যায়, ৩ কোটি ৮১ হাজার ১৮২ ডোজ টিকার ঘাটতি রয়েছে।
দেশে এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করেছেন ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য মতে, দেশের মোট জনংসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১০ হাজার)।
বাংলাদেশ গত ২১ জানুয়ারি থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজার টিকা পেয়েছে। এর পর গত বুধবার আসে ১৭ লাখ ৭৭ হাজার টিকা। এটিসহ চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রায় এক কোটি টিকা পাবে বলে মোটামুটি নিশ্চিত।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিনোফার্মের কাছ থেকে কেনা অন্তত ৫০ লাখ টিকা ও কোভ্যাক্সের আওতায় আরও ১০ লাখ টিকা এ মাসে পাবে বাংলাদেশ। জাপানের উপহার দেওয়া অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১৩ লাখ ৫৭ হাজার টিকাও এ মাসে আসবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ করা ফাইজারের (যুক্তরাষ্ট্রের) ৬০ লাখ টিকা পাঠানোর প্রস্তুতিও নিয়েছে কোভ্যাক্স। ফাইজারের টিকা মাইনাস ২০ ডিগ্রি থেকে ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয় বিধায় এ টিকা সংরক্ষণের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পর তা পাঠানো হবে।
তবে জানা গেছে, এ মুহূর্তে ৬০ লাখ ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের সুবিধা বাংলাদেশের নেই। যে তাপমাত্রা ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের প্রয়োজন তাতে ৩০ লাখ টিকার সংরক্ষণের সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের। সে জন্য ধাপে ধাপে ফাইজারের টিকা পাঠাতে অনুরোধ জানিয়ে কোভ্যাক্সকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ।
এ ছাড়া সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ফ্রিজার কিনছে বাংলাদেশ। যে কোনো দিন এ ফ্রিজার দেশে আসার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন আমাদের সময়কে বলেন, আমরা টিকার নিরবচ্ছিন্ন জোগান নিশ্চিতের উদ্যোগ নিয়েছি।
চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে ৬ কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছি। আগেই দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি রয়েছে। যেগুলো পর্যায়ক্রমে আসছে। নতুন কেনা চুক্তির টিকাও আগামী মাস থেকে আসা শুরু হবে বলে আশাবাদী। আর কোভ্যাক্স থেকেও টিকা পাব আমরা।
এ পর্যন্ত দেশে সাতটি টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে অনুমোদন পায় কোভিশিল্ডের টিকা।
চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি কোভিশিল্ড টিকার অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ২৯ এপ্রিল সিনোফার্মের টিকার অনুমোদ দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
২৭ মে দেশে জরুরি প্রয়োগের অনুমতি পায় ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জরুরি ব্যবহারে জন্য ২৯ জুন মডার্নার টিকার অনুমতি দেয়।
দেশে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী গণটিকাদান কার্যক্রমে মডার্নার টিকা যুক্ত হয় ১৩ জুলাই। এ ছাড়া ২৭ এপ্রিল স্পুৎনিক-ভি, ৩ জুন সিনোভ্যাক, ১৫ জুন জনসন অ্যান্ড জনসন জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। তবে এসব টিকা এখনো দেশে আসেনি। /আমাদের সময়/
মন্তব্য করুন